নতুন বছরে পাইপলাইনের মাধ্যমে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ডিজেল পরিবহন শুরু হবে। এরই মধ্যে এ পাইপলাইনের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। এতে বছরে ২৩৬ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) কর্মকর্তারা এ বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন।
বিপিসির চেয়ারম্যান আমিন উল আহসান কালবেলাকে বলেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে পরীক্ষামূলক আর মার্চে বাণিজ্যিকভাবে অপারেশনে যাবে চট্টগ্রাম-ঢাকা তেলের পাইপলাইন। এ লাইন দিয়ে মূলত ডিজেল পরিবহন করা হবে। পাইপলাইনটি চালু হলে অপচয় ও চুরি অনেকখানি কমে যাবে। তিনি বলেন, এখন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় তেল পরিবহনের ক্ষেত্রে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। রেলওয়ের ওয়াগহন থাকলেও লোকোমোটিভ পাওয়া যায় না। গত সপ্তাহেও লোকোমোটিভ পাওয়ার জন্য খোদ রেলওয়ে সচিবের সঙ্গে কথা বলতে হয়েছে। সড়কপথে পণ্য পরিবহনে যানজটসহ নানা সমস্যা হয়, দীর্ঘ সময় লাগে। জলপথেও সমস্যা হয়। পাইপলাইনটি চালু হলে এসব সমস্যা শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে। তিনি আরও বলেন, আমাদের ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের মধ্যে ডিজেল ৭০ শতাংশ। সেটা সরবরাহ নিশ্চিত হবে পাইপলাইনটি চালু হলে। পেট্রোল ও অকটেন আগে যেভাবে সরবরাহ করা হতো, কখনো রেলওয়ে ওয়াগনে করে, কখনো নদীপথে ট্যাঙ্কারে করে ও সেভাবেই আসবে।
বিপিসির কর্মকর্তারা জানান, দেশে ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের ৯২ শতাংশ আমদানি করা হয়। বছরে দেশে জ্বালানি তেলের গড় চাহিদা ৬৫ লাখ মেট্রিক টন। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৫৯ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। এর মধ্যে ৩০ লাখ ৮০ মেট্রিক টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল জি-টু-জি চুক্তির আওতায় এবং ২৮ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে আমদানি করা হবে। এর বাইরে ১৪ লাখ মেট্রিক টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বিপিসি। পরিশোধিত জ্বালানি তেলের মধ্যে ডিজেল, মোগ্যাস, জেট এ-১, ফার্নেস অয়েল এবং মেরিন ফুয়েল রয়েছে। পরিশোধিত তেলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমদানি করা হয় ডিজেল। দেশের ডিজেলের চাহিদার ৪০ শতাংশ ব্যবহার হয় ঢাকায়। বর্তমানে ঢাকায় তেল পরিবহনের করতে প্রথমে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে নদীপথে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল ও ফতুল্লা ডিপোতে নেওয়া হয়। এরপর সেখান থেকে সড়কপথে ঢাকায় তেল পরিবহন করা হয়। পরিবহনে ব্যবহৃত হয় প্রতি মাসে প্রায় ১৫০টি ছোট-বড় জাহাজ। এতে বছরে দুইশ কোটি টাকার বেশি খরচ হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাইপলাইনটি চালু হলে সড়ক ও জলপথে পরিবহনের জন্য কোনো টাকা ব্যয় হবে না। শুধু পরিচালন, রক্ষণাবেক্ষণ, বিদ্যুৎ বিল, জমির ভাড়াসহ কিছু খাতে ব্যয় হবে ৯০ কোটি টাকা। বছরে প্রকল্পটি থেকে আয় হবে ৩২৬ কোটি টাকা। সাশ্রয় হবে ২৩৬ কোটি টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নে যে টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে, তা আগামী ১৬ বছরের মধ্যে উঠে আসবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ফলে একদিকে যেমন জ্বালানি তেল পরিবহন খরচ কমবে, অন্যদিকে নির্বিঘ্ন হবে সরবরাহ ব্যবস্থা। একই সঙ্গে পরিবেশদূষণ কমবে। শুষ্ক মৌসুমে নৌপথে নাব্য কমে যাওয়ায় তেল পরিবহন করার যে সংকট, তা-ও আর থাকবে না।
জানা গেছে, নদীপথে লাইটারেজে করে পরিবহন কেন্দ্র করে একটি বিশাল সিন্ডিকেট বিদ্যমান। গোদনাইল ডিপো তেল চুরির জন্য স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিচিত। সেই চুরিকে জায়েজ করতে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হতো লাইটারেজ থেকে তেল খালাসের সময় অপচয় বলে। পাইপলাইন হয়ে গেলে সেই বিষয়টিও নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে মনে করছে বিপিসি। প্রকল্পটি ঠেকিয়ে রাখতে শুরুতে তেল পরিবহনকারী লাইটারেজ মালিকরা প্রকাশ্যে মাঠে নেমেছিল।
শুরুতে এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ২ হাজার ৮৬১ কোটি ৩১ লাখ টাকা। পরে সংশোধিত হয়ে বেড়ে ব্যয় দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকায়। এটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড। সেনাবাহিনী ২৪ ব্রিগেড পাইপলাইন নির্মাণের কাজ সফলভাবে সম্পন্ন করায় এখন নারায়ণগঞ্জ (গোদনাইল ডিপো) থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত জেট ফুয়েল পরিবহনে পাইপলাইন নির্মাণের কাজও তাদের দেওয়া হবে বিপিসির সূত্রে জানা গেছে। বিপিসি অর্থায়নে গৃহীত ঢাকা-চট্টগ্রাম পাইপলাইনের দৈর্ঘ্য ২৩৭ কিলোমিটার। এর মধ্যে কুমিল্লা থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত ৫৯ কিলোমিটার। ফতুল্লা থেকে গোদনাইল ডিপো পর্যন্ত সাড়ে ৮ কিলোমিটার।
সেচ মৌসুম নিয়ে আগাম প্রস্তুতি নিচ্ছে বিপিসি: সেচ মৌসুম নিয়ে আগাম প্রস্তুতি নেওয়ার কথা জানিয়েছেন বিপিসির চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, সেচ মৌসুমে কোনো সমস্যা হবে না। আমরা আগাম প্রস্তুতি নিচ্ছি। প্রাক্কলিত চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের পরিবেশকদের কনফারেন্স করা হচ্ছে। সেটিও সেচ মৌসুম সামনে রেখে।
দেশের শস্যভান্ডার খ্যাত উত্তরাঞ্চলের জ্বালানি পরিবহন ব্যবস্থা ছিল খুবই জটিল—বহুঘাট ও হাত ঘুরে। লাইটারেজে করে তেল নেওয়া হতো বাঘাবাড়ি, সেখান থেকে ট্যাঙ্কলরি, আরেকটি রুট হচ্ছে রেলওয়ের মাধ্যমে পৌঁছানো। এখন সেখানেও পরিবর্তন এনেছে বাংলাদেশ ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন। দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় নিরবচ্ছিন্ন, দ্রুত ও সাশ্রয়ীভাবে জ্বালানি সরবরাহের জন্য ২০১৮ সালে ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। ৩ হাজার ৬২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৩১ দশমিক ৫০ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের সময়কাল ছিল ২০২৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত। নির্ধারিত সময়ের আগেই পাইপলাইনটি চালু হয়েছে। ভারতের নুমালীগড় থেকে বাংলাদেশের পার্বতীপুর ডিপো পর্যন্ত বিস্তৃত এ পাইপলাইনের মাধ্যমে বর্তমানে চাহিদা অনুযায়ী তেল আমদানি করা হচ্ছে।